চাকমা খাবার

চাকমাদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব খাবার ও অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নিজস্ব রন্ধন পদ্ধতি বা প্রণালি। এ সকল অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন রন্ধনপদ্ধতি তাদেরকে অন্যান্য জাতি থেকে সহজে পৃথক করে। যেমন— চাকমারা সাধারণত শাক ও সবজি তরকারিতে কদাচিৎ তেল ব্যবহার করে থাকে। অধিকাংশ শাক শুধুমাত্র  সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। শাক অনুসারে নাপ্পি ব্যবহার করা হয়। তবে শাকের সাথে মরিচ বাত্যা বা মরিচ গুদেয়্যে অবশ্যম্ভাবী। খাওয়ার মরিচও বিভিন্নভাবে তৈরি করা হয়। যেমন— নাপ্পি, শুটকি, রসুন, মাছ মিশিয়ে মরিচ বাত্যা তৈরি করা হয়। নাপ্পি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বার্মিজ ‘ঙাপি’ শব্দটি সংস্কৃতায়ন হয়ে এদেশে ‘নাপ্পি’ হয়েছে। ঙা মানে মাছ, পি মানে পিষ্ট করা। অর্থাৎ ঙাপ্পি মানে মাছের পেষ্ট [paste] । সাগরের ছোট জাতীয় মাছ ও কাঁকড়াকে বিশেষ পদ্ধতিতে শুকানোর পর সেগুলো গুঁড়ো করে পেষ্ট-এ পরিণত করা হয়। অতঃপর নাপ্পি তৈরি করা হয়। নাপ্পিকে চাকমারা বলেন ‘সিদোল’। চাকমাদের দৈনন্দিন রান্নাবান্নায় সিদোল অপরিহার্য একটি জিনিস। সরকারি পাঠ্যপুস্তকে এটিকে কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর প্রিয় খাবার বলেও পরিচিতি করানো হয়েছে। আসলে নাপ্পি বা সিদোল কোনো খাবার নয়। এটি এক ধরনের স্বাদবর্ধক মসলা মাত্র। চাকমারা অনেক ক্ষেত্রে এটিকে ‘রুচ্ছেল’ নামেও অভিহিত করে। কোনো তরকারির স্বাদ নির্ভর করে রুচ্ছেল-এর উপর। তবে রুচ্ছেল বলতে শুধুমাত্র সিদোলকে বোঝায় না। তরকারি রান্না করার জন্য তেলসহ অন্যান্য মসলাগুলোকেও বোঝানো হয়ে থাকে।

গোরাং

চাকমাদের মধ্যে যে সকল রন্ধন প্রক্রিয়া রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু হচ্ছে গোরাং। তাজা বাঁশের চোঙায় রান্না করা হলে সেটিকে গোরাং বলে নামে অভিহিত করা হয় । বাঁশের মধ্যে রান্না করার কারণে তরকারি আলাদা গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে । গোরাং পদ্ধতিতে তরকারি রান্না করার জন্য প্রথমে পরিমাণমত একটি বাঁশের চোঙা কেটে নিয়ে সেটিকে পরিষ্কার করে নিতে হয়। পরে তরকারি অনুসারে মরিচ, তেল, হলুদ এবং অন্যান্য মসলাদি তরকারির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। মিশ্রণটি বাঁশের চোঙাটিতে ঢুকিয়ে কলাপাতা দিয়ে চোঙাটির মুখ ঢেকে দিয়ে জ্বলন্ত আগুন বা জ্বলন্ত কয়লার উপর বসিয়ে দিয়ে অবস্থা বুঝে ঘুরিয়ে দিতে হয় যাতে চোঙাটির চারপাশে আগুনের তাপ লাগে। বাঁশের চোঙায় রান্না করতে সাধারণত পানি দিতে হয়। তরকারি  সেদ্ধ হওয়ার জন্য পরিমাণমত পানি বাঁশের চোঙা থেকে বের হয়ে থাকে। পানি মিশিয়ে দিলে বরঞ্চ পানি উপচে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

হলা

স্বল্প সময়ে খাওয়ার জন্য চাকমারা হলা জাতীয় তরকারি রান্না করে থাকে। সাধারণত ডিম, মাছ ও মাংস হলা করে খাওয়া হয়। শুধুমাত্র তেল ও পেঁয়াজ দিয়ে হলা পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধনিয়া পাতা, বাগোর বা ফুজি জাতীয় মসলা দিয়ে হলা তরকারি রান্না করা হয়। মাছ ও মাংস  সেদ্ধ হওয়ার পর সামান্য ঝোল রেখে রান্না শেষ করা হয়। এছাড়া ব্যক্তি বিশেষে অনেকে কাঁচা মরিচ দিয়ে থাকে। তবে ডিম হলা করার সময় পানি ব্যবহার করা হয় না।

সিক্যা

আঞ্চলিক উচ্চারণে এটিকে অনেকে সেক্যাও বলে থাকেন। বাঁশের ছোট সূচালো কঞ্চি বা লোহার শলাকায় মাছ বা মাংস বিদ্ধ করে সেটিকে জলন্ত আগুন বা কয়লার সামান্য দূরত্বে রেখে সিক্যা তৈরি করা হয়। যতক্ষণ না মাছ বা মাংস পুরোপুরি  সেদ্ধ না হবে ততক্ষণ আগুনের কাছাকাছি রাখা হয়। সিক্যা তৈরি করতে চাকমারা সাধারণত কোনো মসলা ব্যবহার করে না। শুধুমাত্র লবণ ও হলুদ মাখানো হয়। পূর্বে অসুস্থ রোগীকে চাকমারা মাছ সিক্যা দিয়ে ভাত খেতে দিত। মাছের মধ্যে প্রথম পছন্দ থাকত ফলিমাছ। এ মাছকে চাকমারা রোগবিহীন বলে বিশ্বাস করে। রোগীর জন্য এ মাছকে উপযোগী মনেকরা হয়।

গাবিদিয়্যা বা গাবি

চাল গুড়ো করে পানির সাথে মিশিয়ে দিলে যে মিশ্রণ তৈরি করা হয় সে মিশ্রণটিকে চাকমারা গাবি বলে থাকে। কিছু কিছু সবজি ও মাছ তরকারিতে চাকমারা গাবি দিয়ে থাকে। গাবি দিলে সেটিকে গাবিদিয়্যা তরকারি বলা হয়। অনেকে গাবিকে করইও বলে থাকে। কচি বেগুন, তিদেবেগোল বিচি, শুকনো মাছ, মুলা, চিংড়ি ইত্যাদি গাবি দিয়ে রান্না করা হয়। সাধারণত তরকারি  সেদ্ধ হওয়ার পরে গাবি দেয়া হয়।

তাবাদ্যা বা তাবা

পানির সাথে সিদোল মিশিয়ে তাবা বানানো হয়। এজন্য তাবাদ্যা তরকারি বললে সেখানে সিদোলের উপস্থিতি আছে বুঝে নিতে হবে। সাধারণত সবজি তরকারি তাবাদ্যা প্রক্রিয়ায় রান্না করা হয়। তরকারিভেদে তাবা’র সাথে শুকনো ইছা/ইচা শুটকি দেয়া হয়। তবে মাছ ও মাংস তাবা দিয়ে রান্না করা হয় না।

গুদেইয়্যে

কোনো একটি তরকারিকে বাঁশের চোঙা বা পাত্রে রান্না করার পর কাঠি দিয়ে গুঁড়ো করার প্রক্রিয়াকে গুদেইয়ে বলা হয়। তবে তরকারিভেদে গুঁড়ো করা হয়। সব ধরনের তরকারিকে গুদেইয়ে বানিয়ে খাওয়া যায়। গোল আলু, পেঁপে, মুরগির মাংস, ছিগোন শাক [এক প্রকার জংলী সবজি], মাছ, মূলা, শূকরের মাংসের সাথে বরণাশাক, বাচ্চুরি (বাঁশ কোঁড়াল, Bamboo Shoot), কচুর ডগা ইত্যাদি গুদেইয়ে খাওয়া হয়। তবে বাঁশের চোঙাতে গুদেইয়ে তরকারির স্বাদ বেশী হয়ে থাকে।

করবো বা হোরবো

চাকমাদের এ জাতীয় খাবার বা তরকারি দুইটি ভাগে খাওয়া হয়। ১. মরিচের সাথে সিদোল মিশিয়ে; ২. মরিচের সাথে রসুন-পেঁয়াজ মিশিয়ে। প্রথম পদ্ধতিতে সাধারণত কুল, তেঁতুল, মুলা, শশা, ক্ষীরা, পেঁপে ইত্যাদি সবজি জাতীয় তরকারি করবো বানিয়ে খাওয়া হয়। অবশ্য অনেকে শশা ও ক্ষীরা শুধুমাত্র মরিচের সাথে রসুন মিশিয়ে খেয়ে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে  সেদ্ধ মুরগির মাংস, শুকনো হাঙ্গর মাছ, শুটকি করবো বানিয়ে খাওয়া হয়। তবে অনেকে শুকনো হাঙ্গর মাছ, শুটকি সিদোল-মরিচের সাথে খেয়ে থাকে। তবে চাকমারা মাংসের সাথে সিদোল মিশিয়ে তরকারি রান্না করে না।

পিদে (পিঠা)