সুগুনি ঝুল
![](https://sritirshaad.com/wp-content/uploads/2023/09/40-Suguni-Jhul.jpg)
সুগুনি ঝুল
উপকরণ:
মাছের শুটকি, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, হলুদ, জিরা, লবণ, তেল, ও চালের গুড়া।
রন্ধন প্রনালী:
চুলায় গরম তেলের মধ্যে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে তাতে রসুন বাটা, হলুদ, জিরা গুড়া, ও লবণ যোগ করতে হবে। মিশ্রণটি মোটামুটি কষানো হলে তাতে ছোট করে কেটে রাখা মাছের শুটকি দিয়ে দিতে হবে। ভালোমতো কষানো হলে পানি দিয়ে সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর চালের গুড়ার গাবি (পানিতে গোলানো চালের গুড়া) যোগ করতে হবে তিন চার মিনিট জাল করে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে। এই রান্নায় বেশ খানিকটা ঝোল থাকে।
স্মৃতি
প্রথম যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই, ২০০১ সালে, তখন তেমন কাউকে চিনতাম না। অবশ্য আমার এক বন্ধুও ভর্তি হয়েছিল শুধু তাকেই চিনতাম। ভর্তি হওয়ার পর পর লক্ষ করলাম যে আমাদের সিনিয়র কিছু ছেলেমেয়ে কেন জানি আমাকে দেখলে মুচকি মুচকি হাসতো। কারণটা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতো আমি লক্ষ্য করতাম। তারপর আমরা গেলাম পিকনিকেঅে সেখানে লক্ষ্য করলাম সিনিয়র একটা ছেলে বারে বারে আমার দিকে তাকাচ্ছে খানিকটা উদ্দেশ্য পূর্ণ দৃষ্টি। তখন আমি বুঝতে পারিনি যে সে চাকমা। ওর চেহারাটা একটু বাঙ্গালীদের মত ছিল। তাই দেখে আমি মনে করেছি সে বড়ুয়া। সেই ছেলে পিকনিকের সানগ্লাস পরে ঘুরে বেড়ায়, আমার দিকে তাকায়, আমিও তাকে খেয়াল করি, কিন্তু কোনো কথা হয়নি সেদিন। এরপরেও অনেকবারই দেখেছি তাকে ক্যাম্পাসে কিন্তু সেভাবে বলার মতো কিছু না। বেশ কিছুদিন পরে একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাটেল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাচ্ছি। আমরা সাধারণত হোস্টেলে থাকতাম ট্রেনে তেমন চড়া হতো না। ট্রেনে উঠে দেখি অনেক ভিড় কোনমতে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি যে আমার ডিপার্টমেন্টের অনেকেই সেখানে আছে। তাদের মধ্যে একজন আমাকে ডেকে বলল, “আসো আসো সাবরিনা এখানে বসো”। আমি সেখানে গিয়ে বসার পরে দেখি আমাদের আশেপাশের সিনিয়াররা আমাকে নিয়ে মিটি মিটি হাসছে। সম্ভবত সেই ছেলেটা আমার জন্য সিটটা ছেড়ে দিয়েছিল এবং সে কাছেই দাঁড়িয়েছিল। তার বেশ কিছুদিন পরে আমার এক চাকমা বন্ধুর মাধ্যমে সে আমার কাছে একটা বই উপহার হিসেবে পাঠায়। তখন আমি বুঝতে পারি যে সে আমাকে পছন্দ করে। আমি বাড়ির বড় মেয়ে আমার, সেরকমের কোন ভাবনা ছিল না আমার, মূল লক্ষ্য ছিল পড়ালেখা শেষ করব চাকরি করব তারপরে পরিবার যা সেদ্ধান্ত নেয় তাই করবো। তার বেশ কিছুদিন পরে একদিন রাঙ্গামাটিতে আমরা বাহির থেকে বাড়িতে এসে জানলাম একটা ছেলে এসেছিল আমাদের বাড়িতে, সে আমার খোঁজ করছিল, আমি বুঝলাম না কে এসেছিল। ছুটি শেষে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারলাম যে সেই ছেলেটা এসেছিলো। আমি তো একই সাথে বিস্মিত এবং তার সাহস দেখে অবাক। তারপর আমার বন্ধুর মাধ্যমে চিঠি দিল, ফোন করা শুরু করলো। আমি অ্যাভয়েড করতেও পারিছি না, কারণ তারা সিনিয়র, আমাদের বই লাগে নোট লাগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের পরামর্শ সহযোগিতা লাগে। এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যেত কারণ তার কাছে বেশ কিছু দুর্লভ বই ছিল। পরে একদিন সে সরাসরি তার ভালো লাগার কথা বলল, আমাকে আমাকে বিয়ে করার কথা বলল। আমি অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম, আমার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আলোচনা করলাম। আমার বিচলিত দশা দেখে বন্ধুরা বললো এত দুশ্চিন্তার দরকার নাই মন না টানলে সারাসরি না বলে দেয়াটা ভালো হবে। তখন আমি তাকে ফোন করে বললাম যে আপনি আগামীকাল আসেন, আপনার সাথে কথা বলবো। পরদিন আমি অপেক্ষা করলাম কিন্তু সে আসলো না। কেনো আসলো না তার কারণ আমি আজও জানিনা, কিন্তু এই না আসাটাই তার জন্য ভালো হলো- তার কপাল খুলে গেল। কারণ তার পরে যেদিন তার সাথে আমার দেখা হল সেদিন আমি আর না বলতে পারলাম না। তারপর থেকেই তার সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হলো। আমাদের বিয়ে হলো ২০০৬ সালে। শ্বশুরবাড়ি গেলাম, নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। দেখলাম আমার শাশুড়ি একটা বিশেষ পদ্ধতিতে শুটকি গাবি রান্না করেছেন, বেশ খানিকটা ঝোল আছে। খেয়ে দেখলাম যে এটা খেতে বেশ মজা। আরও জানতে পারলাম এটা আমার হাজব্যান্ডের বিশেষ পছন্দ। আর একটা খাবার তার পছন্দ ছিল সেটা হলো শূকরের ঠ্যাং রান্না। আমার শাশুড়ির কাছ থেকে বিশেষভাগে এই দুটো রান্না পদ্ধতি শিখে নিলাম। পরের ১৬ বছর অসংখ্যবার আমি এই দুটো খাবার রান্না করছি। এটা জীবনের একটা নিয়মিত অংশে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে তা গেলো যখন কোভিড আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে আমার হাজবেন্ড আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। তারপরে আর কখনো এগুলো রান্না করা হয়নি। কেনো রান্না করবো, আপ কার জন্যই বা রান্না করবো। হাসিখুশি জীবনটা এখন সন্তানকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিনত হয়েছে।
–সাবরিনা চাকমা