খাবারের স্মৃতি
ছেলেবেলার মাহ্চ সিক্যা
এস.এস.সি. পর্যন্ত গ্রামে বড় হয়েছি। বিশাল একটা খালি জায়গা ছিল তখন কাপ্তাই লেকে এবং মাছ পাওয়া যেতো প্রচুর। একটা বড়শি ফেললেই তাতে মাছ উঠে আসতো। এবং খুবই সুস্বাদু। আবার চৈত্রের প্রখর রোদে কচুরিপানা হালকা করে উঠালে দেখা যেত মাছ শুয়ে আছে, তার কোন খেয়াল নেই, সহজেই ধরে ফেলা যেতো।
এত মাছ ছিল। গ্রীষ্মে লেক শুকিয়ে আসলে খালি জায়গাগুলোতে আমরা- ছেলেপেলেরা খেলতাম। কোথাও কোথাও সামান্য পানি জমে থাকতো আমরা তখন ওর ভেতরে মাছ ধরতাম। মাছগুলো ধরে পরিষ্কার করে আগুনে পুড়িয়ে খেতাম। শুধুমাত্র লবণ আর হলুদ মাখিয়ে লাকড়ির আগুনের তাপে সেঁকে খেতাম। অনেকটা এখনকার বারবিকিউ করার মত আমরা বলতাম সিক্যা। খুবই সুস্বাদু। বহু আগে থেকেই এভাবে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আমাদের সময় কেউ অসুস্থ হলে- জ্বর-টর হলে ফলি মাছের সিক্যা খাওয়াতো। অসুস্থ হলে তখন হয়তো মসলা খেলে তার ক্ষতি হবে বা খেতে ভালো লাগে না এমন কারণেও হতে পারে। তখন মাছের সিক্যা দিয়ে ভাত খেতে দিত। তবে অন্য কোন মাছ নয়, শুধুমাত্র ফলি মাছ। আমরা বলি ফলোই মাছ। ফলোই মাছ বা ফলি মাছ কে নিরোগী মাছ বলা হয়। অর্থাৎ এ মাছে কোন রোগ নাই।
– শুভ্র জ্যোতি চাকমা, রিসার্চ অফিসার, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি।
জেঠিমার কলাগাছ তরকারি স্বাদ ভুলতে পারিনি
আমার দুই চোখে দেখা- আমার এক জেঠিমার কলাগাছ তরকারি রান্না করা। কলাগাছ তরকারি আমরা তো খাই- বাজারে বিক্রি করে কলাগাছ। তার স্বাদ আমি এখনো ভুলতে পারিনি।
জেঠিমা অনেক আগে মারা গেছে। জুমে গিয়ে দেখি জেঠিমা কলাগাছ রান্না করছেন। জুম থেকে নিয়ে আসা কলাগাছ ছোট টুকরা করে কাটলেন সিদল গোলানো পানিতে কাটা কলাগাছ গুলো দিলেন- তারপর জুম থেকে আনা ধনেপাতা দিলেন। আর দিলেন জুমের ফুজি। দেখতে মনে হয় সেদ্ধ হয়নি, কিন্তু ধরলে নরম। খেতে যা মজা- জীবনে আমি এরকম মজা পাইনি। ঝোলটাও মজা কলাগাছটাও মজা।
–অনুপ্রভা চাকমা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা, রাঙ্গামাটি
“ও পছন্দ করতো, ওর মৃত্যুর আর রান্না কখনও করিনি”
প্রথম যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই, ২০০১ সালে, তখন তেমন কাউকে চিনতাম না। অবশ্য আমার এক বন্ধুও ভর্তি হয়েছিল শুধু তাকেই চিনতাম। ভর্তি হওয়ার পর পর লক্ষ করলাম যে আমাদের সিনিয়র কিছু ছেলেমেয়ে কেন জানি আমাকে দেখলে মুচকি মুচকি হাসতো। কারণটা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতো আমি লক্ষ্য করতাম। তারপর আমরা গেলাম পিকনিকেঅে সেখানে লক্ষ্য করলাম সিনিয়র একটা ছেলে বারে বারে আমার দিকে তাকাচ্ছে খানিকটা উদ্দেশ্য পূর্ণ দৃষ্টি। তখন আমি বুঝতে পারিনি যে সে চাকমা। ওর চেহারাটা একটু বাঙ্গালীদের মত ছিল। তাই দেখে আমি মনে করেছি সে বড়ুয়া। সেই ছেলে পিকনিকের সানগ্লাস পরে ঘুরে বেড়ায়, আমার দিকে তাকায়, আমিও তাকে খেয়াল করি, কিন্তু কোনো কথা হয়নি সেদিন।
এরপরেও অনেকবারই দেখেছি তাকে ক্যাম্পাসে কিন্তু সেভাবে বলার মতো কিছু না। বেশ কিছুদিন পরে একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাটেল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাচ্ছি। আমরা সাধারণত হোস্টেলে থাকতাম ট্রেনে তেমন চড়া হতো না। ট্রেনে উঠে দেখি অনেক ভিড় কোনমতে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি যে আমার ডিপার্টমেন্টের অনেকেই সেখানে আছে। তাদের মধ্যে একজন আমাকে ডেকে বলল, “আসো আসো সাবরিনা এখানে বসো”। আমি সেখানে গিয়ে বসার পরে দেখি আমাদের আশেপাশের সিনিয়াররা আমাকে নিয়ে মিটি মিটি হাসছে। সম্ভবত সেই ছেলেটা আমার জন্য সিটটা ছেড়ে দিয়েছিল এবং সে কাছেই দাঁড়িয়েছিল।
তার বেশ কিছুদিন পরে আমার এক চাকমা বন্ধুর মাধ্যমে সে আমার কাছে একটা বই উপহার হিসেবে পাঠায়। তখন আমি বুঝতে পারি যে সে আমাকে পছন্দ করে। আমি বাড়ির বড় মেয়ে আমার, সেরকমের কোন ভাবনা ছিল না আমার, মূল লক্ষ্য ছিল পড়ালেখা শেষ করব চাকরি করব তারপরে পরিবার যা সেদ্ধান্ত নেয় তাই করবো। তার বেশ কিছুদিন পরে একদিন রাঙ্গামাটিতে আমরা বাহির থেকে বাড়িতে এসে জানলাম একটা ছেলে এসেছিল আমাদের বাড়িতে, সে আমার খোঁজ করছিল, আমি বুঝলাম না কে এসেছিল। ছুটি শেষে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারলাম যে সেই ছেলেটা এসেছিলো। আমি তো একই সাথে বিস্মিত এবং তার সাহস দেখে অবাক। তারপর আমার বন্ধুর মাধ্যমে চিঠি দিল, ফোন করা শুরু করলো। আমি অ্যাভয়েড করতেও পারিছি না, কারণ তারা সিনিয়র, আমাদের বই লাগে নোট লাগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের পরামর্শ সহযোগিতা লাগে। এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যেত কারণ তার কাছে বেশ কিছু দুর্লভ বই ছিল। পরে একদিন সে সরাসরি তার ভালো লাগার কথা বলল, আমাকে আমাকে বিয়ে করার কথা বলল। আমি অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম, আমার বন্ধুবান্ধবদের সাথে আলোচনা করলাম। আমার বিচলিত দশা দেখে বন্ধুরা বললো এত দুশ্চিন্তার দরকার নাই মন না টানলে সারাসরি না বলে দেয়াটা ভালো হবে। তখন আমি তাকে ফোন করে বললাম যে আপনি আগামীকাল আসেন, আপনার সাথে কথা বলবো। পরদিন আমি অপেক্ষা করলাম কিন্তু সে আসলো না। কেনো আসলো না তার কারণ আমি আজও জানিনা, কিন্তু এই না আসাটাই তার জন্য ভালো হলো- তার কপাল খুলে গেল। কারণ তার পরে যেদিন তার সাথে আমার দেখা হল সেদিন আমি আর না বলতে পারলাম না।
আমাদের বিয়ে হলো ২০০৬ সালে। শ্বশুরবাড়ি গেলাম, নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। দেখলাম আমার শাশুড়ি একটা বিশেষ পদ্ধতিতে শুটকি গাবি রান্না করেছেন, বেশ খানিকটা ঝোল আছে। খেয়ে দেখলাম যে এটা খেতে বেশ মজা। আরও জানতে পারলাম এটা আমার হাজব্যান্ডের বিশেষ পছন্দ। আর একটা খাবার তার পছন্দ ছিল সেটা হলো শূকরের ঠ্যাং রান্না। আমার শাশুড়ির কাছ থেকে বিশেষভাগে এই দুটো রান্না পদ্ধতি শিখে নিলাম। পরের ১৬ বছর অসংখ্যবার আমি এই দুটো খাবার রান্না করছি। এটা জীবনের একটা নিয়মিত অংশে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে তা গেলো যখন কোভিড আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে আমার হাজবেন্ড আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। তারপরে আর কখনো এগুলো রান্না করা হয়নি। কেনো রান্না করবো, আপ কার জন্যই বা রান্না করবো। হাসিখুশি জীবনটা এখন সন্তানকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিনত হয়েছে।
–সাবরিনা চাকমা
“জীবনে একবারই একটা শূকর শিকার করেছি”
শূকরের মাংস চাকমাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। বিভিন্ন ভাবে এটি রান্না করা হয়, বিভিন্ন জিনিসের সাথে রান্না করা হয়। এক একটা জিনিসের সাথে এক একটা পদ্ধতিতে রান্নার স্বাদ ভিন্ন এবং সবগুলিই মজার। রান্না করে বা শিক কাবাব বা বারবিকিউ করে কিংবা বাঁশের ভেতরে রান্না করে বিভিন্নভাবে শূকরের মাংস খাওয়া যায় এবং এটা বিয়ে হোক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হোক সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে খাদ্য তালিকায় অবশ্যই থাকবে। গৃহপালিত ও বন্য দুই ধরনের শূকর পাওয়া যায়। বন্য শূকর বেশী সুস্বাদু, চর্বি কম থাকে এবং এর দামও তুলনামূলকভাবে বেশী হয়। শূকর গোরাং চাকমাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। বাঁশের ভেতরে দিয়ে আগুনের আঁচে রান্না করার যে পদ্ধতি সেটাকে বলে গোরাং।
চাকমারা যখন জুম চাষে অথবা জঙ্গলের ভেতরে খাবারের সন্ধানে অথবা শিকারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘযাত্রা করতো তখন তাদের সাথে তেমন কোন সরঞ্জাম থাকতো না। যখন যেখানে যে ধরনের খাবার পাওয়া যায় এবং যে উপকরণ পাওয়া যায় তা দিয়েই একটা খাদ্য প্রস্তুত করে করে নিতো। রান্না করার জন্য চুলা বা প্রাত্র থাকতো না সাথে, ফলে মুরগি, মাছ, শূকর কিংবা সবজি যা-ই পাওয়া যাক না কেন সেটাকে বাঁশ বা কলাপাতায় মুড়ে কাঠ-কয়লার আগুনের আঁচে রান্না করা থেকেই এই রান্নার প্রচলন। চাকমাদের খাদ্য সংগ্রহে অতীতে শিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমি নিজেও শিকার করে খাবার সংগ্রহ করেছি।
ছাত্রজীবনে খাগড়াছড়িতে আমি আর আমার এক সঙ্গী শিকারের উদ্দেশ্যে বন্দুক নিয়ে সকালবেলা বের হয়েছি। একটা ছড়ির উজান ধরে কিছুটা আগানোর পরেই শূকরের পদচিহ্ন দেখতে পেলাম। দেখে বুঝলাম যে একটা শূকরটা উপর দিকে গেছে এবং আমরা অনুসরণ করলাম। বেশ খানিকটা এগুনোর পর আমরা শূকরটাকে দেখতে পেলাম ঝোপঝাড় থেকে খাবার খেতে ব্যস্ত, আমাদের উপস্থিতি টের পায়নি কারণ তখন বাতাস বিপরীত দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল ফলে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ তার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। শূকরের ঘ্রাণশক্তি প্রবল, কোনোভাবে ঘ্রাণ পেয়ে গেলে ওটাকে আর শিকার করা যেতো না। দূর থেকে বন্দুকের গুলিতে আমি শূকরটাকে শিকার করি। তারপর বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে করে সেটাকে লোকালয়ে নিয়ে আসি। সেখানে তখন এক আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়। প্রায় ৮০ কিলোগ্রামের মতো মাংস হয়েছিলো। এখন তো বাজারে গেলে কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু সে সময় এত বেশী বাজারও ছিল না আর খাবারের জোগানো কম ছিল। কোনকিছুই সহজে পাওয়া যেত না, কবে পাওয়া যাবে তারও ঠিক ছিল না যে কারণে এরকম কিছু একটা পাওয়া গেলে সেটা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার হতো।
ওটা ছিলো আমার জীবনের একমাত্র শিকার। আমি আর কখনো কিছু শিকার করিনি– পাখিও মারিনি।
-স্মৃতি ময় চাকমা, রাঙ্গামাটি
ছাত্র জীবনের আলু গুদেইয়ে
ছাত্র জীবনে অনেক খেতাম আলু গুদেইয়্যে। এসএসসি পাস করে ঢাকার নটরডেম কলেজে ভর্তি হই এবং কলেজ হোস্টেলে থাকা শুরু করি। নিজেরা রান্না করেই খেতাম কয়েকজন চাকমা বন্ধু মিলে। পকেটে তো তেমন টাকা পয়সা থাকত না আর আলু ছিল তখন সবচেয়ে সস্তা। তাই আলুই ছিল ভরসা। বেশীরভাগ দিন আলু গুদেইয়্যে বানাতাম যা অনেকটা আলু ভর্তার মতোই তবে সিদল দেয়া থাকে। তার সাথে একটা ডিম- এই ছিল অধিকাংশ দিনের মেন্যু। রাঙ্গামাটিতে আমরা ছোট আলু খেতাম কিন্তু ঢাকায় তো সেটা পাওয়া যেত না তাই ঢাকায় বড় আলু দিয়েই আলু গুদেইয়্যে বানাতাম।
-অর্কিড চাকমা, সংবাদপত্র কর্মী।