প্রকাশনা

Videos

চাকমা স্মৃতির স্বাদ

চাকমা জীবন, খাবার, রান্নার পদ্ধতি, খাবারে সামাজিক অবস্থার প্রভাব এবং স্মৃতি

বেগুন গাবি রান্না

তেল ছাড়া মুরগি রান্না

প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাশরুম

কচি কলা গাছ রান্না

মাছ রান্না

ঐতিহ্যবাহী খাবার পাজন

কয়লার আঁচে ফলি মাছ

মরিচ বাটার সাথে সেদ্ধ শাক

বাঁশের ভেতরে শূকরের মাংস রান্না

ভিন্ন ধরণের ঝোলসহ শুটকি রান্না

চাকমা জনগোষ্ঠী ও খাদ্যরীতি

Article

চাকমা জনগোষ্ঠী ও খাদ্যরীতি

শুভ্র জ্যোতি চাকমা
রিসার্চ অফিসার, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি

বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও স্ব-স্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অনেকগুলো সংখ্যালঘিষ্ঠ জনজাতি সুদীর্ঘকাল ধরে বাস করে আসছে। দীর্ঘসময় ধরে এ সকল জনজাতিগুলোর সঠিক সংখ্যা কত তা আমাদের জানা ছিল না। তবে সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত  একটি কমিটি দীর্ঘদিন ধরে যাচাই-বাচাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পঞ্চাশটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজাতির সংখ্যা নিরূপণ করেছে। এবং তাদের নাম উল্লেখপূর্বক গেজেট প্রকাশ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এ তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। আপাতত সরকারি বরাত দিয়ে এখন আমরা বলতে পারব, দেশে পঞ্চাশটি সংখ্যালঘু জনজাতির বসবাস রয়েছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ‘সংহতি’ নামক সংকলনে দেশে ৪৫টি জাতিসত্তার নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। সংখ্যা নিয়ে নানা বিতর্ক আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করছিলাম। স্বাধীনতার ৪৮ বৎসর পরেও এ সংখ্যা নিরূপণ করতে না পারা আমাদের জাতীয় একটি ব্যর্থতা ছিল বলতে হবে। অবশেষে সরকারের তরফ থেকে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান আপাতত এ বিতর্ককে থামিয়ে দিয়েছে। এ সংখ্যালঘিষ্ঠ জনজাতিগুলোর স্বতন্ত্র সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যা জানতে পারলে আমরা আরো উপকৃত হতাম।

সরকারি ভাষায় বর্তমানে তাদের পরিচিতি ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী”। পূর্বে বলা হত ‘উপজাতি’। এ সকল অভিধা রীতিমতো হাস্যকর, অপমানজনকও বটে। জাতি হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়া বা স্বীকার না করার কৌশল হিসেবে এ সকল পরিচিতি দেয়া হয় কি না তা আমাদের রীতিমতো ভাবিয়ে তোলে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে- এ সকল জনজাতিগুলোর কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী দেশে জাতি হিসেবে পরিচিত ও স্বীকৃত। ভৌগোলিক সীমারেখার কারণে এরা আমাদের দেশে কখনো উপজাতি, কখনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। কী বিচিত্র! যাহোক, এ সকল পরিচিতিকে প্রত্যাখ্যান করে তারা নিজেদেরকে ‘জাতি’ হিসেবে মনে করে থাকে। এ সকল জনজাতিগুলোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হল চাকমা। জনসংখ্যা অনুসারে দেশে বাঙালির পরে চাকমাদের অবস্থান। অর্থাৎ দেশে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমা। বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজাতি চাকমাদের সম্পর্কে জানার কৌতূহল ও আগ্রহ আমাদের দেশের অনেকের আছে। কিন্তু এ বিষয়ে তথ্যবহুল পর্যাপ্ত প্রকাশনা না থাকায় চাকমাদের সম্পর্কে অনেকের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী চাকমাদের সম্পর্কে অতটা ওয়াকিবহাল নয়। তাদের ধারণাও স্পষ্ট নয়। আমরা এমনও দেখেছি, সরকারি পাঠ্যপুস্তকে চাকমাদের সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে বা যে সকল তথ্য পরিবেশীত হয়েছে সেগুলো রীতিমতো আপত্তিকর। যেমন—চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। তারা ভাতের সাথে মাছ, মাংস এবং শাকসবজি খেতে ভালোবাসে। অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী” শীর্ষক অধ্যায়ে চাকমাদের বিষয়ে এটি লেখা হয়েছে। অপরদিকে ৭ম শ্রেণির সপ্তবর্ণা বইয়ে এ কে শেরাম-এর ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখা হয়েছে- চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস ও শাক-সবজি। এ ধরনের উপস্থাপনা অবশ্যই তাচ্ছিল্যের মধ্যে পড়ে। এছাড়া অধিকাংশ তথ্য ভুল। ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ কোমলমতি শিশুর মনে চাকমাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্মলাভ করবে তাতে সন্দেহ নেই। এ প্রেক্ষাপটে আলোচ্য প্রবন্ধে চাকমাদের খাদ্য ও রন্ধনপ্রণালি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

চাকমাদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব খাবার ও অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নিজস্ব রন্ধন পদ্ধতি বা প্রণালি। এ সকল অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন রন্ধনপদ্ধতি তাদেরকে অন্যান্য জাতি থেকে সহজে পৃথক করে। যেমন— চাকমারা সাধারণত শাক ও সবজি তরকারিতে কদাচিৎ তেল ব্যবহার করে থাকে। অধিকাংশ শাক শুধুমাত্র  সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। শাক অনুসারে নাপ্পি ব্যবহার করা হয়। তবে শাকের সাথে মরিচ বাত্যা বা মরিচ গুদেয়্যে অবশ্যম্ভাবী। খাওয়ার মরিচও বিভিন্নভাবে তৈরি করা হয়। যেমন— নাপ্পি, শুটকি, রসুন, মাছ মিশিয়ে মরিচ বাত্যা তৈরি করা হয়। নাপ্পি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বার্মিজ ‘ঙাপি’ শব্দটি সংস্কৃতায়ন হয়ে এদেশে ‘নাপ্পি’ হয়েছে। ঙা মানে মাছ, পি মানে পিষ্ট করা। অর্থাৎ ঙাপ্পি মানে মাছের পেষ্ট [paste] । সাগরের ছোট জাতীয় মাছ ও কাঁকড়াকে বিশেষ পদ্ধতিতে শুকানোর পর সেগুলো গুঁড়ো করে পেষ্ট-এ পরিণত করা হয়। অতঃপর নাপ্পি তৈরি করা হয়। নাপ্পিকে চাকমারা বলেন ‘সিদোল’। চাকমাদের দৈনন্দিন রান্নাবান্নায় সিদোল অপরিহার্য একটি জিনিস। সরকারি পাঠ্যপুস্তকে এটিকে কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর প্রিয় খাবার বলেও পরিচিতি করানো হয়েছে। আসলে নাপ্পি বা সিদোল কোনো খাবার নয়। এটি এক ধরনের স্বাদবর্ধক মসলা মাত্র। চাকমারা অনেক ক্ষেত্রে এটিকে ‘রুচ্ছেল’ নামেও অভিহিত করে। কোনো তরকারির স্বাদ নির্ভর করে রুচ্ছেল-এর উপর। তবে রুচ্ছেল বলতে শুধুমাত্র সিদোলকে বোঝায় না। তরকারি রান্না করার জন্য তেলসহ অন্যান্য মসলাগুলোকেও বোঝানো হয়ে থাকে। চাকমারা বলে:

“তোন সুয়াদ অয় রুচ্ছেলে

পোজা দোল লাগে গুচ্ছেলে।”

অর্থাৎ

তরকারি স্বাদ হয় রুচ্ছেলে

জিনিসপাতি সুন্দর লাগে গুছানো হলে।

টক ও তেতো জাতীয় সবজি রান্না করতে হলে সিদোল অবশ্যই ব্যবহার করতে হয়। এটি টক ও তেতো কমায়। তবে এ সিদোল খাওয়াকে কেন্দ্র করে চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীকে হীন দৃষ্টিতে দেখা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দৈনন্দিন রান্নায় অপরিহার্য একটি উপাদান হলেও চাকমারা সিদোল তৈরি করতে পারে না। এটি তৈরি করে থাকে দেশের রাখাইন জনগোষ্ঠীর লোকেরা। পৃথিবীর অনেক মোঙ্গলীয় দেশেও সিদোল খাওয়া হয়। সিদোল ছাড়াও সাবারাং, ফুজি, বাগোর ইত্যাদি হচ্ছে চাকমাদের নিজস্ব মসলাজাতীয় পাতা। এগুলো তরকারিতে মিশিয়ে দিলে অন্যরকম স্বাদ ও সুগন্ধ হয়ে থাকে। তরকারি অনুসারে এ সকল মসলা স্বাদবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এবার চাকমাদের খাবার রন্ধন পদ্ধতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এ যাবত চাকমা খাবার ও রন্ধনপ্রণালি বিষয়ে উল্লেখ্যযোগ্য কোনো প্রকাশনা নেই। এ বিষয়ে কেউ গভীরভাবে ভেবেছেন, লিখেছেন সে ধরনে নজিরও পাওয়া যায় না। শুধু মুখে মুখে প্রচলন রয়েছে— চাকমাদের রান্না করা খাবার অত্যন্ত স্বাদ। প্রাথমিক গবেষণা বা অনুসন্ধান করে চাকমাদের মধ্যে খাবার রান্না করার ১৫ ধরনের পদ্ধতি জানা গেছে। এ পদ্ধতিগুলো নিঃসন্দেহে বৈচিত্র্যময়। বলা যায়, এ সবের মধ্য দিয়ে চাকমাদের গৌরবময় সংস্কৃতির চিত্র ফুটে ওঠে। চাকমাদের খাবার রন্ধন পদ্ধতিগুলো হচ্ছে— পুজ্যা, সিক্যা, উচ্যা, ওদেইয়ে/গুদেয়্যে, তাবাদ্যা, খলা, ভাজা, রান্যাহ্, পোগোনত্দ্যা, ভাতপুগোলঘতদ্যা, ঝুল, করবো, গাবিদিয়্যা, গোরাং, কেবাং ইত্যাদি। নিচে উল্লিখিত রন্ধনপদ্ধতিগুলোকে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হল।

পুজ্যা

জলন্ত আগুন বা কয়লায় পুড়িয়ে যে সকল খাবার খাওয়া হয় সে পদ্ধতিকে পুজ্যা বলা হয়। সাধারণত আলু (সকল প্রকার আলু), রেং (এক প্রকার লতায় ধরে] ভুট্টা, কাঁচা কলা, শুকনো শুটকি, শুকনো হাঙ্গর মাছ ইত্যাদি জ্বলন্ত কয়লায় পুড়িয়ে খাওয়া হয়। আবার পুড়িয়ে  সেদ্ধ হওয়ার পর শুটকি ও হাঙ্গর মাছ কোরবো বানিয়েও খাওয়া হয়। কেউ কেউ নিজস্বভাবে তৈরি করা পিঠা যেমন—বিনিহঘা, সান্যে পিঠা, কলা পিঠা গরম করে খেতে চাইলে আগুলের জ্বলন্ত কয়লার পুড়িয়ে গরম করেন।

সিক্যা

আঞ্চলিক উচ্চারণে এটিকে অনেকে সেক্যাও বলে থাকেন। বাঁশের ছোট সূচালো কঞ্চি বা লোহার শলাকায় মাছ বা মাংস বিদ্ধ করে সেটিকে জলন্ত আগুন বা কয়লার সামান্য দূরত্বে রেখে সিক্যা তৈরি করা হয়। যতক্ষণ না মাছ বা মাংস পুরোপুরি  সেদ্ধ না হবে ততক্ষণ আগুনের কাছাকাছি রাখা হয়। সিক্যা তৈরি করতে চাকমারা সাধারণত কোনো মসলা ব্যবহার করে না। শুধুমাত্র লবণ ও হলুদ মাখানো হয়। পূর্বে অসুস্থ রোগীকে চাকমারা মাছ সিক্যা দিয়ে ভাত খেতে দিত। মাছের মধ্যে প্রথম পছন্দ থাকত ফলিমাছ। এ মাছকে চাকমারা রোগবিহীন বলে বিশ্বাস করে। রোগীর জন্য এ মাছকে উপযোগী মনেকরা হয়।

উচ্যা

উচ্যা মানে  সেদ্ধ করানো। শুধুমাত্র লবণ দিয়ে কোনো কিছুকে  সেদ্ধ করাকে চাকমারা উচ্চা বলে থাকে। অবশ্য কেউ কেউ সামান্য সিদোল পানির সাথে মিশিয়ে দিয়ে  সেদ্ধ করে। তখন একে বলা হয় ‘পহন পহন’ সিদোল পানি দিয়ে উচ্যা। বিশেষত শাক জাতীয় তরকারিকে চাকমারা শুধুমাত্র  সেদ্ধ করে খেয়ে থাকে। কোনো কোনো বিশেষ জাতীয় সীমও  সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। এছাড়া যেকোনো ধরনের আলু, কাঁচা কলা, রেং ইত্যাদি শুধুমাত্র লবণ দিয়ে  সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। তবে শাক জাতীয় তরকারি  সেদ্ধ করে খাওয়ার সময় চাকমাদের মরিচ বাত্যা অবশ্যই থাকতে হয়। নচেৎ খাওয়ার মধ্যে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। নাপ্পি, শুটকি, রসুন, মাছ মিশিয়ে মরিচ বাত্যা তৈরি করা হয়। কেউ কেউ ধনিয়া  ও পেঁয়াজও মিশিয়ে থাকে। এতে মরিচবাত্যার আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়।

ওদেইয়ে/গুদেয়্যে

কোনো একটি তরকারিকে বাঁশের চোঙা বা পাত্রে রান্না করার পর কাঠি দিয়ে গুঁড়ো করার প্রক্রিয়াকে গুদেইয়ে বলা হয়। তবে তরকারিভেদে গুঁড়ো করা হয়। সব ধরনের তরকারিকে গুদেইয়ে বানিয়ে খাওয়া যায়। গোল আলু, পেঁপে, মুরগির মাংস, ছিগোন শাক [এক প্রকার জংলী সবজি], মাছ, মূলা, শূকরের মাংসের সাথে বরণাশাক, বাচ্চুরি (বাঁশ কোঁড়াল, Bamboo Shoot), কচুর ডগা ইত্যাদি গুদেইয়ে খাওয়া হয়। তবে বাঁশের চোঙাতে গুদেইয়ে তরকারির স্বাদ বেশী হয়ে থাকে।

তাবদ্যা

পানির সাথে সিদোল মিছিয়ে তারা বানানো হয়। এজন্য তাবাদ্যা তরকারি বললে সেখানে সিদোলের উপস্থিতি আছে বুঝে নিতে হবে। সাধারণত সবজি তরকারি তাবাদ্যা প্রক্রিয়ায় রান্না করা হয়। তরকারিভেদে তাবা’র সাথে শুকনো ইছা/ইচা শুটকি দেয়া হয়। তবে মাছ ও মাংস তাবা দিয়ে রান্না করা হয় না।

হলা

স্বল্প সময়ে খাওয়ার জন্য চাকমারা হলা জাতীয় তরকারি রান্না করে থাকে। সাধারণত ডিম, মাছ ও মাংস হলা করে খাওয়া হয়। শুধুমাত্র তেল ও পেঁয়াজ দিয়ে হলা পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধনিয়া পাতা, বাগোর বা ফুজি জাতীয় মসলা দিয়ে হলা তরকারি রান্না করা হয়। মাছ ও মাংস  সেদ্ধ হওয়ার পর সামান্য ঝোল রেখে রান্না শেষ করা হয়। এছাড়া ব্যক্তি বিশেষে অনেকে কাঁচা মরিচ দিয়ে থাকে। তবে ডিম হলা করার সময় পানি ব্যবহার করা হয় না।

ভাজা

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে ভাজা করার পদ্ধতির ন্যায় চাকমাদের ভাজা। ডিম, মাছ, মাংস, শুকনো হাঙ্গর মাছ, ইছা ইত্যাদি জাতীয় তরকারি চাকমারা পছন্দ অনুসারে ভাজা করে খেয়ে থাকে। এছাড়া সবজির মধ্যে শিম, কলার মোচা ভাজা করে খাওয়া হয়।

রান্যাহ্ 

রান্যা মানে রন্ধন করাকে বোঝানো হয়। সকল প্রকার মাছ, মাংস, সবজি রান্না করে খাওয়া হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে তরকারিভেদে সিদোলসহ অন্যান্য শুটকি, ইছা মাছ ইত্যাদি রান্না করা হয়। এতে তেল প্রয়োজন হয়। পছন্দ অনুসারে একটির সাথে অন্য পদের তরকারি মিশিয়েও রান্না করা হয়। চাকমাদের রান্যাহ্ বিভিন্ন উপায়ে সম্পন্ন করা হয়। যেমন— পাত্রে, বাঁশের চোঙায়, পোগোনত দিয়ে। পোগোনত দিয়ে পদ্ধতিতে রান্না করার বিষয়টি নিম্নে আরো আলোচনা করা হবে।

পোগোনত্দ্যা

চাকমাদের এ পদ্ধতির রন্ধন প্রক্রিয়াটি খুবই আকর্ষণীয়। খাবার বা তরকারি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে পোগোনত দিয়ে রান্না করা হয়। চাকমাদের সান্যা পিঠা, কলা পিঠা, ব্যাঙ পিঠা, বিনি হঘা, বিনি পিঠা ইত্যাদি জাতীয় পিঠা  সেদ্ধ করার জন্য নিজস্ব পোগোন রয়েছে। একটি বড় আকারের পাত্রের মধ্যে পরিমাণমত পানি দিয়ে তার উপরে নিচে ছিদ্রযুক্ত অন্য একটি মাটির হাঁড়ি বা পাত্র তুলে দেয়া হয়। এ ছিদ্রযুক্ত পাত্রকে চাকমারা পোগোন বলে থাকেন। এ পোগোনের ভিতর তৈরি করে রাখা পিঠাগুলোকে সাজিয়ে রেখে ঢেকে দেয়া হয়। পরে চুলার উপর বসিয়ে দেয়া হয়। প্রচণ্ড গরমে নিচের পানি যখন ফুটতে থাকে তখন পোগোনের ভিতর রাখা পিঠাগুলো  সেদ্ধ হয়ে যায়। বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে পোগোনত দিয়ে বিন্নি ভাতও রান্না করে খাওয়া হয়। উপরিউক্ত পিঠাগুলো  সেদ্ধ করতে চাকমারা কোনো তেল ব্যবহার করেন না। উল্লেখ্য যে, চাকমাদের পিঠাগুলো তৈরি করতে কলাপাতা ও একপ্রকার জংলি উদ্ভিদের পাতা ‘পেত্যাপাদা প্রয়োজন হয়ে থাকে। অনেকে ভুরপাদাও ব্যবহার করে থাকেন। এ সকল পাতা ব্যবহার করার কারণে পিঠাগুলো সুস্বাদু গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।

ভাতপুগুলঘতদ্যা

ভাত রান্না করার পর গরম ভাতের উপরে কলাপাতায় মুড়ে নিয়ে ডিম, শুটকি, ইছা মাছ, অন্যান্য সামগ্রিক ছোট জাতীয় শুকনো মাছ ভাতপুগুলঘত্ দিয়ে রন্ধন করা হয়। তবে ভাত রান্না করার পানি শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পূর্ব থেকে প্রস্তুত করে রাখা তরকারির মিশ্রণ গরম ভাতের উপরে বসিয়ে দিতে হয়। তা না হলে খাওয়ার উপযোগী মতন তরকারি  সেদ্ধ হবে না। এজন্য পূর্ব থেকে প্রয়োজনীয় লবণ, তেল, হলুদ, রসুন ও মরিচ মাখিয়ে রাখতে হয়। স্বাদের ভিন্নতা আনয়নে অনেকে ধনিয়া পাতা, বোম্বে বাগোর ইত্যাদি জাতীয় মসলা পাতা ব্যবহার করে থাকেন। চাকমাদের এ ধরনের রান্নার স্বাদ বেশী।

ঝুল

ঝুল মানে হচ্ছে ঝোল। তরকারির চেয়ে ঝোলের পরিমাণ বেশী হলে চাকমারা সেটিকে ঝোল বলে অভিহিত করেন। এ জাতীয় তরকারির সংখ্যা খুব বেশী নেই। চাকমারা সাধারণ লবণ ইলিশ, ইছা মাছ ও শুটকি ঝোল করে খেয়ে থাকে। সাধারণত তরকারি পরিমাণের চেয়ে খাওয়ার লোকের সংখ্যা বেশী হলে এবং দ্রুত খেতে চাইলে ঝোল তরকারি রান্না করা হয়। এ পদ্ধতির রান্নায় মরিচ, তেল ব্যবহার করা হয়। তবে সিদোল দিয়ে ঝোল জাতীয় তরকারি রান্না করা হয় না।

করবো

চাকমাদের এ জাতীয় খাবার বা তরকারি দুইটি ভাগে খাওয়া হয়। ১. মরিচের সাথে সিদোল মিশিয়ে; ২. মরিচের সাথে রসুন-পেঁয়াজ মিশিয়ে। প্রথম পদ্ধতিতে সাধারণত কুল, তেঁতুল, মুলা, শশা, ক্ষীরা, পেঁপে ইত্যাদি সবজি জাতীয় তরকারি করবো বানিয়ে খাওয়া হয়। অবশ্য অনেকে শশা ও ক্ষীরা শুধুমাত্র মরিচের সাথে রসুন মিশিয়ে খেয়ে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে  সেদ্ধ মুরগির মাংস, শুকনো হাঙ্গর মাছ, শুটকি করবো বানিয়ে খাওয়া হয়। তবে অনেকে শুকনো হাঙ্গর মাছ, শুটকি সিদোল-মরিচের সাথে খেয়ে থাকে। তবে চাকমারা মাংসের সাথে সিদোল মিশিয়ে তরকারি রান্না করে না।

গাবিদিয়্যা

চাল গুড়ো করে পানির সাথে মিশিয়ে দিলে যে মিশ্রণ তৈরি করা হয় সে মিশ্রণটিকে চাকমারা গাবি বলে থাকে। কিছু কিছু সবজি ও মাছ তরকারিতে চাকমারা গাবি দিয়ে থাকে। গাবি দিলে সেটিকে গাবিদিয়্যা তরকারি বলা হয়। অনেকে গাবিকে করইও বলে থাকে। কচি বেগুন, তিদেবেগোল বিচি, শুকনো মাছ, মুলা, চিংড়ি ইত্যাদি গাবি দিয়ে রান্না করা হয়। সাধারণত তরকারি  সেদ্ধ হওয়ার পরে গাবি দেয়া হয়।

গোরাং

চাকমাদের মধ্যে যে সকল রন্ধন প্রক্রিয়া রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু হচ্ছে গোরাং। তাজা বাঁশের চোঙায় রান্না করা হলে সেটিকে গোরাং বলে নামে অভিহিত করা হয় । বাঁশের মধ্যে রান্না করার কারণে তরকারি আলাদা গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে । গোরাং পদ্ধতিতে তরকারি রান্না করার জন্য প্রথমে পরিমাণমত একটি বাঁশের চোঙা কেটে নিয়ে সেটিকে পরিষ্কার করে নিতে হয়। পরে তরকারি অনুসারে মরিচ, তেল, হলুদ এবং অন্যান্য মসলাদি তরকারির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। মিশ্রণটি বাঁশের চোঙাটিতে ঢুকিয়ে কলাপাতা দিয়ে চোঙাটির মুখ ঢেকে দিয়ে জ্বলন্ত আগুন বা জ্বলন্ত কয়লার উপর বসিয়ে দিয়ে অবস্থা বুঝে ঘুরিয়ে দিতে হয় যাতে চোঙাটির চারপাশে আগুনের তাপ লাগে। বাঁশের চোঙায় রান্না করতে সাধারণত পানি দিতে হয়। তরকারি  সেদ্ধ হওয়ার জন্য পরিমাণমত পানি বাঁশের চোঙা থেকে বের হয়ে থাকে। পানি মিশিয়ে দিলে বরঞ্চ পানি উপচে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

কেবাং

কলাপাতায় মুড়ে যে সকল খাবার রান্না করা হয় সেটিকে চাকমারা কেবাং বলে থাকে। সাধারণত ডিম, শুটকি, মাছ ইত্যাদি কেবাং পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। রান্না করার পূর্বে তরকারিতে পরিমাণমত মরিচ, মসলা, লবণ, তেল মিশিয়ে রেখে মিশ্রণটিকে কলাপাতায় মুড়ে নিতে হয়। অতঃপর সেটিকে জ্বলন্ত কয়লার উপর বসিয়ে দিতে হয়। তবে মোচাটি যাতে শুধুমাত্র একপাশ পুড়ে না যায় সেদিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হয় । কলাপাতায় রান্না করার কারণে কেবাং তরকারি থেকে আলাদা গন্ধ বের হয় যা ভক্ষণকারীকে সহজে আকৃষ্ট করে থাকে।

শুগুনি কেবাং

বর্তমানে চাকমাদের খাদ্য ও রান্না জনপ্রিয়তা লাভ করায় তিনটি পার্বত্য জেলায় প্রচুর চাকমা খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। পর্যটকদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে এ সকল খাবারের প্রতি। বাঁশের চোঙা ও কলাপাতায় রান্না করা যথাক্রমে গোরাং ও কেবাং চাকমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় তরকারি। এ দুই প্রকারের রান্নার পদ্ধতি চাকমাদের শ্রেষ্ঠ রান্নার পদ্ধতি হিসেবে সকলের নিকট পরিচিত। যেকোনো জাতিসত্তার মানুষ এগুলোকে পছন্দ করে থাকে। এছাড়াও চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব পিঠা। এগুলো হচ্ছে- সান্যা পিঠা, বড়া পিঠা, বিনি পিঠা, বিনা খগা, ব্যাং পিঠা, কলা পিঠা ইত্যাদি। বড়া পিঠা বিন্নি চালের গুঁড়ো দিয়ে তেলে ভেজে তৈরি করা হয়। 

অবশিষ্ট পিঠাগুলো কলা, নারিকেল, আখেরমিঠা মিশিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায়  সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। অনেকের মতে, পিঠাগুলোতে তেল দেয়া হয় না বলেই এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী। চাহিদা থাকায় বর্তমানে বিভিন্ন দোকানে চাকমা পিঠাগুলো কিনতে পাওয়া যায়।

পাহাড়িদের খাবারের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। আমরা চাকমাদের খাদ্যসমূহকে উল্লেপূর্বক অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর খাদ্যকে জানার চেষ্ঠা করব। বিচিত্র ধরনের রান্না ও খাবারের পদ্ধতি চাকমাদের জাতীয় জীবনের বর্ণাঢ্য অতীত রয়েছে বলে মনে করা হয়। নামে ভিন্ন হলেও অন্যান্য পাহাড়ি জাতিদের মধ্যে সমধর্মী রান্না ও খাবারের প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে মারমাদের আপ্রেং নামক তরকারি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য অন্যতম একটি তরকারি। পাহাড়িদের রান্না প্রক্রিয়ায় ও খাবারে কোনো প্রিজারভেটিভ কিংবা কৃত্রিম রঙ মেশানো হয় না। কাজেই এগুলোর সুষ্ঠু বিপণন করা সম্ভব হলে বড় অংকের টাকা আয় করা সম্ভব। পাহাড়ি খাবার হিসেবে অনেকে হীন দৃষ্টিতে দেখলেও অধিকাংশের নিকট পাহাড়িদের খাবারগুলো অত্যন্ত প্রিয়। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় বর্তমানে প্রচুর পাহাড়ি হোটেল গড়ে উঠেছে। চাহিদা থাকায় এ সকল হোটেলে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খাবার, তরকারি প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়ে থাকে।