সুগর গোরাং

সুগর গোরাং

উপকরণ:

কলা পাতা, বাঁশ, শূকরের মাংস, আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, সাবারাং, হলুদ, ও লবণ। সরিষার তেল ঐচ্ছিক

 

রন্ধন প্রনালী:

শূকরের মাংস ছোট ছোট করে কেটে ধুয়ে আদা বাটা, রসুন বাটা, কাঁচা মরিচ বাটা, পেঁয়াজ কুচি, হলুদ, ও লবণ একসাথে ভালো করে মাখতে হবে। এর সাথে সরিষার তেল যোগ করা যেতে পারে। এরপর কাঁচা বাঁশের চোঙার খোলা মুখ দিয়ে তিন চতুর্থাংশ পর্যন্ত আলতোভাবে ভরতে হবে। হালকা আগুনের আঁচে কলাপাতা নরম করে নিয়ে তা মুড়ে গোলা পাকিয়ে বাঁশের খোলা মুখ বন্ধ করে দিতে হবে বাঁশকে আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সনাতনী পদ্ধতিতে এর গায়ে কাদামাটির প্রলেপ দেয়া হতো। ধাতব ফয়েল দিয়ে মুড়ে দিলেও একই সুবিধা পাওয়া যায়। এরপর লাকড়ির আগুনে বাঁশগুলোকে কাত করে বসিয়ে দিতে হবে। আগুনের শিখা খুব বেশী না থাকলে ভালো বরং কয়লার আঁচে রান্না ভালো হয়। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত ২০ থেকে ২৫ মিনিট ধরে বাঁশগুলোকে আগুনে রাখতে হবে এবং কিছুক্ষণ পরপর ঘুরিয়ে দিতে হবে। বাঁশের সবুজ রং কালচে হয়ে আসলে আগুন থেকে সরাতে হবে। এরপর পাত্রে ঢেলে পরিবেশন করা যাবে।

 

স্মৃতি:

শূকরের মাংস চাকমাদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। বিভিন্ন ভাবে এটি রান্না করা হয়, বিভিন্ন জিনিসের সাথে রান্না করা হয়। এক একটা জিনিসের সাথে এক একটা পদ্ধতিতে রান্নার স্বাদ ভিন্ন এবং সবগুলিই মজার। রান্না করে বা শিক কাবাব বা বারবিকিউ করে কিংবা বাঁশের ভেতরে রান্না করে বিভিন্নভাবে শূকরের মাংস খাওয়া যায় এবং এটা বিয়ে হোক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হোক সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে খাদ্য তালিকায় অবশ্যই থাকবে। গৃহপালিত ও বন্য দুই ধরনের শুকর পাওয়া যায়। বন্য শূকর বেশী সুস্বাদু, চর্বি কম থাকে এবং এর দামও তুলনামূলকভাবে বেশী হয়। বাঁশের ভেতরে দিয়ে আগুনের আঁচে রান্না করার যে পদ্ধতি সেটাকে বলে গোরাং। চাকমারা যখন জুম চাষে অথবা জঙ্গলের ভেতরে খাবারের সন্ধানে অথবা শিকারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘযাত্রা করতো তখন তাদের সাথে তেমন কোন সরঞ্জাম থাকতো না। যখন যেখানে যে ধরনের খাবার পাওয়া যায় এবং যে উপকরণ পাওয়া যায় তা দিয়েই একটা খাদ্য প্রস্তুত করে করে নিতো। রান্না করার জন্য চুলা বা প্রাত্র থাকতো না সাথে, ফলে মুরগি, মাছ, শূকর কিংবা সবজি যা-ই পাওয়া যাক না কেন সেটাকে বাঁশ বা কলাপাতায় মুড়ে কাঠ-কয়লার আগুনের আঁচে রান্না করা থেকেই এই রান্নার প্রচলন। চাকমাদের খাদ্য সংগ্রহে অতীতে শিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমি নিজেও মিকার করে খাবার সংগ্রহ করেছি। আমার বন্য শূকর শিকারের একটি স্মৃতি আছে। খাগড়াছড়িতে আমি আর আমার এক সঙ্গী শিকারের উদ্দেশ্যে বন্দুক নিয়ে সকালবেলা হয়েছি। একটা ছড়ির উজান ধরে কিছুটা আগানোর পরেই শূকরের পদচিহ্ন দেখতে পেলাম। দেখে বুঝলাম যে একটা শূকর উপর দিকে এবং আমরা অনুসরণ করলাম। বেশ খানিকটা এগুনোর পর আমরা শূকরটাকে দেখতে পেলাম ঝোপঝাড় থেকে খাবার খেতে ব্যস্ত, আমাদের উপস্থিতি টের পায়নি কারণ তখন বাতাস বিপরীত দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল ফলে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ তার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। শূকরের ঘ্রাণশক্তি প্রবল, কোনোভাবে ঘ্রাণ পেয়ে গেলে ওটাকে আর শিকার করা যেতো না। দূর থেকে বন্দুকের গুলিতে আমি শূকরটাকে শিকার করি। তারপর বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে করে সেটাকে লোকালয়ে নিয়ে আসি। সেখানে তখন এক আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়। প্রায় ৮০ কিলোগ্রামের মতো মাংস হয়েছিলো। এখন তো বাজারে গেলে কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু সে সময় এত বেশী বাজারও ছিল না আর খাবারের জোগানো কম ছিল। কোনকিছুই সহজে পাওয়া যেত না, কবে পাওয়া যাবে তারও ঠিক ছিল না যে কারণে এরকম কিছু একটা পাওয়া গেলে সেটা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার হতো।

ওটা ছিলো আমার জীবনের একমাত্র শিকার। আমি আর কখনো কিছু শিকার করিনি– পাখিও মারিনি। 

 

 

-স্মৃতি ময় চাকমা